Ticker

6/recent/ticker-posts

সব সমাপ্তির শেষ থাকেনা

 


মাঝে মাঝে আমাদের শ্বাস প্রশ্বাসকেও বিরক্তিকর মনে হয়, যদিওবা সেটি আমাদের জীবন এবং মৃত্যুর মাঝে একমাত্র ব্যবধায়ক।

অল্প কিছুক্ষন আগেই ঝড় বয়ে গেলো।
বাড়ির পিছনের বড় গাছটা ভেঙে পরেছে।
আকাশে এখনো কালো মেঘের খেলা।
পাল তোলা নৌকা আর মেঘেদের মাঝে অনেকটাই মিল খুজে পায় অরবিন্দ।
কালো মেঘের মতই মুখখানা কালষে হয়ে আছে অরবিন্দের।
নিজের বেচে থাকার একমাত্র অবলম্বন মাকেও
বিরক্তিকর লাগছে।

মায়ের মধুর সুরকেও আজ কর্কষ বজ্রের মত লাগে।
আচমকা পিঠে নরম ঠান্ডা স্পর্শ অনুভব করলো অরবিন্দ।

-- বাবা, ঘরে আয়। বাইরে আর বসে থাকিসনে।
শরীর খারাপ করবে। এই বুঝি আবার বৃষ্টি শুরু হলো। আয় না বাপ.....
-- তুমি এখান থেকে যাও। তোমাকে আর তোমার এই কাচারি ঘরকে আমার অসহ্য লাগে।
আমার সামনে আসবে না তুমি।
-- তুই ছাড়া আমার কে আছে বাপ। ছোট বেলা থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করছি।
বুড়ো বয়সে এই অভাগী মা টাকে দেখবি না?
-- তোমাকে দেখার কোনো প্রয়োজন নাই।
তুমি তো তোমার এই বিশ্রী চোখ টা সবাইকে দেখিয়ে যাচ্ছো। তুমি কেনো বোঝ না..
তোমার এই বিশ্রী চোখ টার জন্য আমি প্রতিনিয়ত অপমানিত হই আমার বন্ধুদের কাছে।
তুমি কেনো আজকে আমার স্কুলে গিয়েছিলে?
তোমাকে কতবার বলেছি
আমার স্কুলে তুমি যাবে না।

-- তুই তো খাবার নিয়ে যাস নি৷ দুপুরে না খেলে সারা বেলা কষ্ট করে থাকতে হত তোর।
আমিও তো যেতে চাই না..
মা হয়ে কিভাবে তোকে অপমানিত হতে দেই বল।
আর যাবো না।
এবার ঘরে আয় শোনা বাপ....

কাদা মিশ্রিত আচল দিয়ে চোখ মুছে মনীষা মাধুরি।
এখন তার চোখে বর্ষা। অবিরত চলে বৃষ্টি।
এই বর্ষা শুরু হয়েছিল বছর পনের আগে।
এখনো চলছে।
চলতে থাকবে। সব শুরুর শেষ থাকলেও
সব সমাপ্তির শেষ থাকে না।

রাত তখন ঘুমোচ্ছে। ঘুম নেই মনীষা মাধুরির।
নিজের জীবনের হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হয়। একটা ঝড় সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়ে যায়। মাধুরী হারিকেনের আলো টা কমিয়ে দেয়।
অল্প আলোর একমাত্র শিখা অরবিন্দের চোখে গিয়ে পরে। কি অপূর্ব চোখ। এই চোখে কত মায়া।
কত ভালোবাসা।
নিশপাপ শিশুর মত ঘুমচ্ছে অরবিন্দ।
অরবিন্দের এই রাগ বুঝতে পারে মনীষা।
ভিটেমাটি বন্ধক রেখে ছেলেকে বড় স্কুলে পড়ায় মনীষা। বড়লোকের ছেলে মেয়ে সবাই।
আমার এই অন্ধ চোখ দেখে সবাই কুৎসা করে।
অরবিন্দ চায় না, আমি আমার এই অন্ধ চোখ নিয়ে তার বন্ধুদের সামনে যাই।
আচ্ছা যাবো না। কখনো যাবো না।
তবুও আমার বাপ ভালো থাকুক। আমার সব সুখ আমার এই অরবিন্দ...

আপন মনে ভাবতে ভাবতে চোখ ভিজিয়ে ফেলে অরবিন্দের মা মনীষা।
এক চোখে বন্যা বয়ে যায়। এই বন্যার স্রোত নির্বিকার হয়ে চেয়ে দেখে অপর চোখ।
তার নেই অশ্রু বিসর্জনের ক্ষমতা।
নেই, সুখে কেদে ফেলার মত সক্ষমতা।
এই চোখে চিরঅন্ধকার.....
অন্ধকারের অসীম সীমানায় ছোট্ট এক রানী সে।

১২ বছর পর............

টেলিভিশনের পর্দায় বিজ্ঞাপন।
দেশের নামকরা চক্ষুবিশেষজ্ঞ এবং সার্জন- ডাক্তার অরবিন্দ।
রুগী দেখেন সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৪ টা পর্যন্ত।

আজ অরবিন্দের অনেক খুশির দিন। সেরা চক্ষু সার্জন হিসেবে পুরষ্কার টা অবশেষে তিনিই পেলেন।
আজ মায়ের কথা খুব মনে পরছে।
সেই যে মা কে গ্রামে একা ফেলে স্ত্রী সন্তান নিয়ে শহরে চলে এসেছে। আর খোজ নেয়া হয়নি।

গতবছর গ্রীষ্মে গাছের পাকা আম আর কাঠাল নিয়ে অরবিন্দের কাছে এসেছিলো মনীষা।
অরবিন্দের ফুটফুটে দুটো মেয়ে হয়েছে।
দেখতে এসেছিলো মনীষা মাধুরি।
কিন্তু সেবারেও তার সুখ কপালে সয়নি।
তিন বছরের নাতনী দুটি, অন্ধ চোখ দেখে
খুব ভয় পেয়েছিল।
মনীষা মাধুরি চলে গেলেন গ্রামে। আর কখনো ছেলের কাছে আসেন নি।
অরবিন্দও কোনো খোজ নেন নি।

কিন্তু আজ খুব ইচ্ছা করছে মায়ের কাছে যেতে।
নিজের এই ভুলগুলোর জন্য ক্ষমা চাইতে খুব ইচ্ছা করছে।
বন্ধু বান্ধব সব কিছুর চাইতে মা মূল্যবান এটা এত বছর পর অরবিন্দের বিবেকে কড়া নেড়ে যাচ্ছে, নিজে বাবা হওয়ার পর থেকে।
মা সে তো মাই। হোক সোনার কাপড়ে মোড়ানো কিংবা ময়লা কাপড়ে পরিহিতা।

মায়ের পছন্দের সব খাবার নিয়ে অরবিন্দ গ্রামে যায়। সব কিছু আগের মতই আছে।
কিন্তু মা কে কোথাও খুজে পায়নি।
প্রতিবেশী একজন জানালেন গত গ্রীষ্মেই তার
মা মারা গেছেন। তাকে জানানোর অনেক চেষ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু খোজ পাওয়া যায়নি।

অরবিন্দের মাথায় আকাশ ভেঙে পরে।
হাত পা হিম হয়ে আসে। পাথরের মত শক্ত হয়ে যায়।
অরবিন্দ আর কোন কথা বলতে পারে নি।
অপরাধী যখন অপরাধ বুঝতে পেরে অনুশোচনা করে তখন সে সীমাহীন কষ্ট পায়।

অরবিন্দ মায়ের বিছানায় শুয়ে থাকে। নীল রঙের বাক্স থেকে একটা চিঠি পায়।
চিঠিতে লেখা ছিলঃ

"" অরবিন্দ.. আমার বাপ।
আমার সেই ছোট্ট শোনা।
চিঠিটা তোকে লিখতেই হলো। আমার এক চোখে পানি। আরেক চোখ অন্ধ। সে দেখতেও পায় না।
কান্না করতেও পারে না।
আমাদের জীবন এমন ছিল না বাপ।
অনেক ভালো ছিলাম আমরা।
তোর বাবা, আমি, আর তুই। অনেক সুখী ছিলাম।
সেই রাতে এক দুর্ঘণায় তোর বাবা মারা গেলেন।
তোর এক চোখ নষ্ট হয়ে গেলো।
তখন তুই অনেক ছোট। তোর সামনে গোটা জীবন। আমি বেচে থাকতে আমার বাপ এক চোখে দেখবে সেটা আমি কি করে হতে দেই।
আমি যে তোর মা রে....
সেদিন আমি তোকে আমার এই চোখ টি দিয়েছিলাম।
তাই আজ আমি অন্ধ। আমি বিশ্রী।
বাবা তোর কি চোখে পানি চলে আসছে?
কাদিস না বাবা।
পৃথিবীটা কত বিচিত্র তাই না বাবা...?
একজন যে এই পৃথিবীতে নেই।
যার সময় সীমা শেষ। তবুও তার চোখ কেদে চলেছে।
সত্যিই সব শুরুর শেষ থাকলেও।
সব সমাপ্তির শেষ থাকে না...............

Post a Comment

0 Comments